হ্ময়চক্র
ক্ষয়চক্র কাকে বলে?
ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়ায় সমুদ্রতল থেকে উত্থিত কোনো ভূভাগ পর্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থা থেকে কতকগুলি নির্দিষ্ট অবস্থার মধ্য দিয়ে সমপ্রায় ভূমিতে বা সমুদ্রতলের উচ্চতায় পৌঁছায়। একে ক্ষয়চক্র বলে।
হ্ময়চক্র |
W.M Davis-এর মতে- "Geographical Cycle is that period of time in which an uplifted land area through weathering and erosion is converted into a plain surface without any characteristics".
ভূবিজ্ঞানী জেমস হার্টন 1785 খ্রিস্টাব্দে ক্ষয়চক্র ধারণাটি প্রথম প্রবর্তন করেন। কিন্তু 1899 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানী William Moris Davis ক্ষয়চক্রের বিজ্ঞানসম্মত ধারণাটি উপস্থাপন করেন। যাকে "Ideal Geographical Cycle of Erosion" বলে। "Erosion" শব্দটি "Erodery" (হ্ময় করা- to gnaw) বা "Erosus" (ক্রমে ক্রমে ক্ষয় হওয়া- to eat away) শব্দ থেকে আগত।
ক্ষয়চক্রের শ্রেণীবিভাগ:
ভূমিরূপ পরিবর্তনকারী প্রাকৃতিক শক্তির তারতম্য অনুসারে ভূপৃষ্ঠের 5টি প্রধান ক্ষয়চক্র দেখা যায়। যথা-
1. নদী দ্বারা নদীজ বা স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র
2. বায়ু প্রবাহ দ্বারা শুষ্কতার ক্ষয়চক্র
3. সামুদ্রিক ক্ষয়চক্র
4. কাস্ট অঞ্চলের ক্ষয়চক্র
5. হিমবাহের ক্ষয়চক্র
ক্ষয়চক্রের নিয়ন্ত্রক/ ডেভিসের ত্রয়ী / "Landscape is a function of structure, process and stage"- ব্যাখ্যা করো।
1899 খ্রিস্টাব্দে W. M Davis স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র (নদীর) বর্ণনা করতে গিয়ে "Landscape is a function of structure, process and stage" উদ্ধৃতিটির অবতারণা করেন। "ভূমিরূপ হল গঠন, প্রক্রিয়া ও পর্যায়ের সম্মিলিত ফল"। ক্ষয়চক্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এই তিনটি নিয়ন্ত্রককে Trio of Davis (ডেভিসের ত্রয়ী) বলে। এক্ষেত্রে-
1. গঠন-- ভূমিরূপের গঠন বলতে তিনি শিলার প্রবেশ্যতা, কাঠিন্য, নতি, ভাঁজ, চ্যুতি, দারণ, ফাটল, শিলা লক্ষণকে বোঝান। ভূমিরূপের গঠনভেদে ক্ষয়চক্রের পার্থক্য দেখা যায়।
2. প্রক্রিয়া- প্রক্রিয়া হল সেইসকল প্রাকৃতিক শক্তি, যেগুলি ভূমিরূপ পর্যায়নে অংশগ্রহণ করে। যেমন- নদী, জলধারা, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ, বায়ু।
3. পর্যায়ন- ভূমিরূপ বিবর্তনের মোট সময়কে Davis কতকগুলি ভাগে ভাগ করেন। এক একটি ভাগকে পর্যায়ে বলে। ক্ষয়চক্রের প্রথম পর্যায়কে তিনি 3টি সাধারণ পর্যায়ে ভাগ করেন-
ক. যৌবন পর্যায়
খ. পরিণত পর্যায় বা পৌঢ় পর্যায়
গ. বার্ধক্য বা অন্তিম পর্যায়
মরু ক্ষয়চক্র বা শুষ্কতার ক্ষয়চক্র (Arid cycle of Erosion)
মরু ক্ষয়চক্র বা শুষ্কতার ক্ষয়চক্র (Arid cycle of Erosion) কী?
মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের কোনো উত্থিত উচ্চভূমি আবহবিকার, বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যে প্রাথমিক অবস্থা থেকে কতকগুলি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সমতলভূমি বা পেডিপ্লেনে পরিণত হলে তাকে শুষ্কতার ক্ষয়চক্র বলে।
উল্লেখ্য- 1905 খ্রী W.M Davis প্রথম শুষ্ক অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের ধারণা দেন। এবং 1948 খ্রী L.C King মরু ক্ষয়চক্রের পাদ সমতলীকরণ মতবাদটি প্রকাশ করেন।
শুষ্ক ক্ষয়চক্রের আদর্শ অবস্থা গুলি কী কী?
1. মরু ক্ষয়চক্রের প্রাথমিক শর্ত হল বৃষ্টিহীন শুষ্ক মরু পরিবেশ (বার্ষিক গড় 25 সেন্টিমিটার এর কম বৃষ্টি)
2. এই ক্ষয়চক্রের আদর্শ ভূভাগ হল- পর্বতবেষ্টিত শুষ্ক মালভূমি, শুষ্ক অববাহিকা বা বোলসন, শুষ্ক উচ্চভূমি (দক্ষিণ আফ্রিকার সাভানা, উত্তর-পশ্চিম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া)
3. এই ক্ষয়চক্রে বায়ু ও জলধারা ভূমিরূপ পরিবর্তনে সমান অংশ নেয়।
4. অনুগামী নদী দ্বারা বহুস্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অববাহিকার সৃষ্টি হবে।
5. অববাহিকার মধ্যে সংযোগকারী কোন নদী থাকবে না।
6. নদীগুলির দৈর্ঘ্য ভিন্ন হবে। কিছু কিছু নদী প্রবাহপথে শুকিয়ে যাবে। কয়েকটি নদী উপত্যকার পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছাবে। এই ক্ষয়চক্রের স্থানীয় ক্ষয়সীমা হবে উপত্যকার পাদদেশের অস্থায়ী হ্রদ বা প্লায়া।
7. ভৌম জলপীঠ হবে এই ক্ষয়চক্রের স্থায়ী ক্ষয়সীমা।
8. বৃষ্টিপাত বেশি হবে না যাতে উপত্যকা জলমগ্ন হয় বা ছাপিয়ে যায়।
9. অঞ্চলটির বাষ্পীভবন মাত্রা হয় অত্যধিক, যাতে ভূমিভাগ খুব রুক্ষ থাকবে ও সহজে ক্ষয়চক্র সম্পন্ন হবে।
মরু ক্ষয়চক্রের বর্ণনা দাও অথবা মরু ক্ষয়চক্র সম্পর্কে ডেভিসের ধারনা
উইলিয়াম মরিস ডেভিস সর্বপ্রথম মরু অঞ্চলের পর্যায়ক্রমিক ভূমিরূপ পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, মরু অঞ্চলের ভূমিরূপ আবহবিকার, প্রবাহমান জলধারা ও বায়ুপ্রবাহের মিলিত কার্যের ফলে সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবাহমান জলধারা মরু অঞ্চলের ভূমিরূপ বিবর্তনের মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত যখন কমে আসে তখন বায়ু মরু অঞ্চলের ভূমিরূপ পরিবর্তনের প্রধান ভূমিকা পালন করে।
যেকোনো শুষ্ক মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্র নিম্নলিখিত 3টি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়-
মরু ক্ষয়চক্র |
A. প্রারম্ভিক পর্যায় (Initial Stage) অথবা যৌবন পর্যায় (Youth Stage)-
জলপ্রবাহ জনিত ক্ষয়কার্যের ফলে যৌবন অবস্থা শুরু হয়।
যৌবন পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
1. ভূ আলোড়ন জনিত ভাঁজ ও চ্যুতিযুক্ত উচ্চভূমি সৃষ্টি হবে ও পর্বতবেষ্টিত উপত্যকা গঠিত হবে।
2. বৃষ্টির প্রভাবে সৃষ্ট অনুগামী নদীগুলি কেন্দ্রমুখী জলনির্গম প্রণালী গড়ে তোলে।
3. উচ্চ বাষ্পীভবন ও স্বল্প বৃষ্টিপাতে কিছু নদী বিলুপ্ত হয়।
4. অববাহিকার মাঝখানে জল জমে অস্থায়ী প্লায়া হ্রদের সৃষ্টি হয়।
5. প্লায়া হল স্থায়ী ক্ষয়সীমা।
6. আবহবিকার, বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যে অবরোহণ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পদার্থগুলি অববাহিকার নিম্নদেশে সঞ্চিত হয় এবং ক্ষয়চক্র শুরু হয়।
|
7. এই পর্যায়ের শুরুতে ভূমির উচ্চতা সর্বাধিক থাকে। ক্ষয়চক্র যত এগোয় উচ্চতা তত কমে।
8. গভীর আবহবিকারে শিথিল শিলাচূর্ণ সৃষ্টি হয়।
9. স্বল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিতে আবহবিকারস্থ পদার্থ অপসারিত হয়। ফলে- পর্বত ঢাল বরাবর "v" আকৃতির উপত্যকা ও ravain সৃষ্টি হয়।
10. আবহবিকারস্থ শিলাচূর্ণ জলধারায় বাহিত হয়ে উপত্যকার সম্মুখে সঞ্চিত হয় ও পললশঙ্কু গঠন করে।
11. একাধিক পলল শঙ্কু পরস্পর যুক্ত হয়ে বাজাদা গঠন করে।
12. হ্ময়ের ফলে আবহবিকার মধ্যবর্তী জলবিভাজিকা সংকীর্ণ হয়।
13. অববাহিকার মাঝে বৃষ্টির জল জমে সৃষ্ট প্লায়া হ্রদে সূহ্ম পলির সঞ্চয় ঘটায়।
14. এই পর্যায়ে উচ্চভূমিতে অবরোহণ ও অববাহিকায় আরোহণ প্রক্রিয়া ভীষণ সক্রিয় থাকে।
15. এই পর্যায়ে উপত্যকায় অপসারণে সৃষ্ট গর্ত (Blow out) সৃষ্টি হয়।
16. উপত্যকার যত্রতত্র বালিয়াড়ি গড়ে ওঠে।
শুষ্ক ক্ষয়চক্রের যৌবন পর্যায় |
C. প্রৌঢ় বা পরিণত পর্যায় (Mature Stage)-
বৃষ্টিপাতের অভাবে বায়ুর কার্য বেশি সক্রিয় হলে পরিণত পর্যায় শুরু হয়। এর ফলে যৌবন থেকে পরিণত অবস্থায় ক্ষয়চক্রের অগ্রগতি অতি ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। ভূমির উচ্চতা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভীষণভাবে কমে যায় বলে, এই পর্যায়ের প্রথমভাগেই জলপ্রবাহের দ্বারা নগ্নীভবন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে যৌবন থেকে পরিণত অবস্থায় ক্ষয়চক্রের অগ্রগতি অতিধীর সম্পন্ন হয়। ক্ষয়চক্রের প্রারম্ভে যখন বায়ুর কাজের প্রাধান্য সক্রিয় ছিল, তা এই সময় প্রাধান্য বিস্তার করে।
প্রৌঢ় বা পরিণত পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
|
1.
2. এই পর্যায়ে ভূমির উচ্চতা হ্রাস পেলেও সঞ্চয় কাজ বাড়ায় অববাহিকার তলদেশে উচ্চতা বাড়ে।
3. পর্বতের সম্মুখ অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পশ্চাদ অপসারণ ঘটে। তাই উপত্যকা বিস্তৃত হয় ও জলবিভাজিকা সংকীর্ণ হয়।
4. পলল শঙ্কু ও বাজাদার বিস্তৃতি ঘটে।
5. পর্বতের সম্মুখ ভাগ ও বাজাদার মাঝের অংশে মৃদু, ঢালু শিলাগঠিত ভূমি পেডিমেন্ট সৃষ্টি হয়।
6. অববাহিকার বিস্তার বৃদ্ধিতে বায়ুর বেগ বাড়ে, অবরোহণ প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়।
7. এই পর্যায়ের শেষে প্লায়া হ্রদগুলি শুকিয়ে যেতে থাকে।
8. মরু অপবাহন সৃষ্টি হয়।
শুষ্ক ক্ষয়চক্রের পরিণত পর্যায় |
D. বার্ধক্য পর্যায় (Old Stage)-
ভূমিরূপ বিবর্তনে জলের কাজ যখন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় যায় এবং কেবল বায়ুর কাজ চলতে থাকে, তখন থেকে বার্ধক্য পর্যায় শুরু হয়।
বার্ধক্য পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য-
|
1. জলধারার কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে বায়ুর কাজ শুরু হয়।
2. সমগ্র ভূমিরূপের উচ্চতা ও বন্ধুরতা কমে।
3. পেডিমেন্টগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে সমগ্র ভূভাগটি প্রায় সমতলে পরিণত হয়। একে Desert Pedi Plain / প্যানক্যান বলে।
4. এই সমপ্রায় ভূমির ওপর ক্ষয় প্রতিরোধকারী শিলাস্তর যে টিলা, অনুচ্চ পাহাড় দ্বীপের ন্যায় অবস্থান করে তাকে ইনসেলবার্জ বলে।
5. বায়ুর কাজ সর্বাধিক সক্রিয় হয় বলে সমপ্রায় ভূমিতে অপসারণ, গর্ত, বালিয়াড়ি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য ভৌমজল পৃষ্ঠ হল শুষ্ক ক্ষয়চক্রের প্রকৃত ক্ষয়সীমা। কারণ এই ভৌমজল পৃষ্ঠের নীচের অংশ ভিজে থাকায় বায়ুর অপসারণ সম্ভব নয়।
ইনসেলবার্জ |
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র অথবা ডেভিস বর্ণিত স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র কাকে বলে?
W.M Davis স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের প্রথম ধারণা দেন (1899)। তাঁর মতে প্রবাহমান জলধারা বা নদী নিয়ন্ত্রিত ক্ষয়চক্রকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে। অর্থাৎ যে ক্ষয়চক্র সামগ্রিকভাবে নদীর কার্যের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয় সেই ক্ষয়চক্রটি ভূবিজ্ঞানে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র নামে পরিচিত। এই ক্ষয়চক্রকে ভৌগোলিক ক্ষয়চক্রও বলে।
ভূপৃষ্ঠের প্রায় 70 শতাংশ ভূমির ভাস্কর্য নদীর স্বাভাবিক ক্ষয় কার্যের মাধ্যমে ঘটে থাকে। তাই একে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বা নদী-ক্ষয়চক্র (Fluvial Cycle of Erosion) বলা হয়।
নদীর ক্ষয়চক্রকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলার কারন-
1. সমস্ত ক্ষয়কারী শক্তিগুলির মধ্যে নদী ও জলধারার ভূমিকা সর্বাধিক।
2. নদীর ক্ষয়কারী শক্তি প্রায় 70% অঞ্চলে প্রধান ক্ষয়কারী শক্তিরূপে ভূমিকা নেয়।
3. নদীর ক্ষয়চক্রটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
4. এই ক্ষয়চক্র সহজে পর্যবেক্ষণ এবং অনুধাবনযোগ্য।
5. নদী দীর্ঘদিন ধরে ধীরগতিতে ক্ষয়চক্র চালানোয় সহজে বোধগম্য।
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের শর্তাবলী
- ক্ষয়চক্রের সূচনা হবে নতুন ভূতাত্ত্বিক উপাদানের সমুদ্রবক্ষ থেকে উত্থানের ফলে।
- ভূমি ভাগের ভূতাত্ত্বিক গঠন হবে সরল ও একই প্রকার শিলা লক্ষণযুক্ত। পরপর কঠিন ও কোমল শিলা সজ্জিত হবে এবং প্রাথমিক ঢাল হবে সমুদ্রমূখী।
- ক্ষয়চক্র চলাকালীন ভূমি ভাগ অনর অবস্থায় বা স্থিতাবস্থায় থাকবে।
- উত্থানপর্ব দ্রুত সম্পন্ন হবে এবং উত্থান কালে তেমন ক্ষয় হবে না।
- অঞ্চলটি আদ্র জলবায়ুর অন্তর্গত হবে যেখানে বিভিন্ন নদী গোষ্ঠীর উদ্ভব হবে ও নদীর ক্ষয় প্রাধান্য পাবে।
- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূমির উত্থান প্রায় উল্লম্ব হবে এবং এর হার এত দ্রুত হবে যে উত্থান কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভূমি ভাগ বিশেষ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না।
- ভূমি ভাগের বিবর্তন একটি নির্দিষ্ট ক্রমপর্যায় অনুসারে ঘটতে থাকবে।
- ক্ষয়ের শেষ সীমা পর্যন্ত নদীর নিম্ন করতে থাকবে।
- নদীর ক্ষয়, আবহবিকার পুঞ্জিতস্খলন, প্রভৃতি বহির্জাত প্রক্রিয়া গুলি একযোগে ভূমিরূপের বিবর্তনের অংশগ্রহণ করবে।
- উত্থিত ভূমি ভাগ সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয় হবে।
- ক্ষয়চক্র আংশিক সম্পন্ন হওয়ার পর ভূমির পুনরায় উত্থান ঘটলে একটি নতুন ক্ষয়চক্রের সূচনা হবে।
ডেভিস বর্ণিত স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বিবরণ অথবা ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্ভূত ভূমিরূপ:
ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র এর ধারণা অনুসারে প্রতিটি ভূমিভাগের ক্ষয় একটি ধারাবাহিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। উত্থানের পর থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভূমিভাগটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় পৌছায় ততক্ষণ ক্ষয়কার্য চলতেই থাকে। যেকোনো ভূমিভাগ এই ক্ষয়চক্রের কোন্ পর্যায়ে আছে তা বোঝার জন্য ভূমিরূপ এর বৈশিষ্ট্য অনুসারে একটি পূর্ণ ক্ষয়চক্রকে তিনটি অবস্থা বা পর্যায়ে ভাগ করা হয়-
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের মডেল |
A. যৌবন অবস্থা (Youthful Stage)- সহজাত বন্ধুরতা নিয়ে একটি ভূমিভাগ সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়। সেই উত্থানপর্ব শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় ভূমিভাগটির যৌবন অবস্থা এবং তখন নদীর ধারা ক্ষয়কার্য শুরু হয়। এর ফলে ওখানে ভূমিরূপ এর কতগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
1. অনুগামী নদীর সৃষ্টি- সদ্য উত্থিত ভূমিভাগটির স্বাভাবিক বা প্রাথমিক ঢাল অনুসারে প্রথমে অল্প কয়েকটি নদীর সৃষ্টি হয়, এদের অনুগামী নদী (Consequenct stream) বলে। এইসব অনুগামী নদীর আবার ছোটো ছোটো উপনদী থাকে। এগুলি মস্তক ক্ষয় (headward erosion) বা উৎসের দিকে হ্ময়ের মাধ্যমে প্রসারিত হয় এবং এদের উপত্যকাগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি জলনির্গম প্রণালী গড়ে তোলে।
2. সংকীর্ণ "V" আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি- ভূমির উচ্চতা তথা ঢাল সর্বাধিক থাকে বলে নদীগুলি খরস্রোতা হয় এবং তাই ক্ষয়কারী শক্তির প্রাধান্যও খুব বেশি হয়। এর ফলে নদীগুলি নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে গভীর ও সংকীর্ণ "V" আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি করে।
3. সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ণ জলবিভাজিকা- নদী উপত্যকা ক্রমশ গভীর ও প্রশস্ত হতে থাকে বলে জলবিভাজিকাগুলিও (পর্বত, শৈলশিরা ও অন্যান্য উচ্চভূমি) ক্রমান্বয়ে সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ণ হয়।
4. বিবিধ ভূমিরূপ- যেসব জায়গায় নদীর গতিপথে পর্যায়ক্রমে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর থাকে সেখানে জলপ্রপাত, খরস্রোত (rapid) প্রভৃতি ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।
5. নদীর পাড় ও ভূমির ঢাল খাড়া- নদীর দুই পাড়ের ঢাল বেশ খাড়া হয় এবং ভূমির ঢাল বহু সংখ্যক রিল (Rills) ও গালি (Gullies)দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের যৌবন অবস্থা |
6. হ্রদ ও জলাভূমির সৃষ্টি- পাশাপাশি প্রবাহিত দুটি নদী উপত্যকার মধ্যবর্তী ভূমি প্রশস্ত হয় এবং ওই অংশে নদীর সংখ্যা খুব কম থাকে। এর ফলে ওখানে জলনিকাশি ব্যবস্থা অনুন্নত হয় এবং নিম্নভূমি অঞ্চলে জল জমে হ্রদ, জলাভূমি প্রভৃতি সৃষ্টি হতে পারে।
7. মন্থকূপ সৃষ্টি- নদীর স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড়ো বড়ো প্রস্তরখন্ডের আঘাতে নদীগর্ভে গোলাকার গর্তের সৃষ্টি হয়, যাকে বলে মন্থকূপ (Pot hole)।
8. ক্রমবর্ধমান আপেক্ষিক উচ্চতা- নদীর নিম্নক্ষয় খুব বেশি হয় বলে উচ্চভূমির শীর্ষদেশ ও নদী উপত্যকার তলদেশের মধ্যে আপেক্ষিক উচ্চতা সর্বাধিক হয়। আবহবিকার বিশেষ হয় না বলে উচ্চভূমিগুলির পরম উচ্চতাও সর্বাধিক থাকে।
9. ভূমিরূপের বিলুপ্তি- যৌবন অবস্থা বা পর্যায়ের শেষের দিকে জলাভূমি, হ্রদ, জলপ্রপাত প্রভৃতি লোপ পেতে থাকে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যৌবন অবস্থার সূচনায় উত্থিত ভূমিভাগটি থাকে কম বন্ধুর এবং সেখানে নদনদীর সংখ্যাও থাকে কম। কিন্তু এরপর যৌবন অবস্থা যতই এগোতে থাকে নদনদীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে যেমন ক্ষয়কার্য বাড়তে থাকে, তেমনি ভূমির বন্ধুরতাও বাড়ে। যৌবন অবস্থার শেষপ্রান্তে সমগ্র ভূমিভাগটি ক্ষয়কার্যের ফলে একেবারে ব্যবচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
B. পরিণত বা পৌঢ় অবস্থা (Mature Stage)- যৌবন অবস্থার শেষে ভূমিভাগটি থেকে যখন তার উত্থিত হওয়ার সময়কার সব চিহ্ন মুছে যায়, তখন শুরু হয় পরিণত বা প্রৌঢ় অবস্থা। এসময়ে ভূমিরূপের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেগুলি হল-
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের পরিণত অবস্থা |
1. চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য- পরিণত অবস্থার সূচনায় ভূমিভাগটিতে চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
a. ব্যবচ্ছিন্ন ভূমির উচ্চ অংশ বা চূড়াগুলি অর্থাৎ জলবিভাজিকাসমূহ সংকীর্ণ ও তীক্ষ্ণ হয়।
b. বন্ধুরতার পরিমাণ হয় সর্বাধিক।
c. পরবর্তী নদী (subsequent stream) ও অন্যান্য নদীসহ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নদনদী এই অবস্থায় প্রবাহিত হয়, ফলে বিভিন্ন প্রকার জলনির্গম প্রণালী (drainage pattern) গড়ে ওঠে এবং
d. মোট ক্ষয়কার্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়।
2. ক্রমহ্রাসমান আপেক্ষিক উচ্চতা- পরিণত অবস্থা যতই এগোতে থাকে ব্যবচ্ছিন্ন ভূমির উচ্চ অংশ বা চূড়াগুলি এবং উপত্যকার তলদেশের মধ্যে আপেক্ষিক উচ্চতা হ্রাস পায়। একই সঙ্গে এই সময় সমগ্র অঞ্চলটির পরম উচ্চতাও হ্রাস পায়।
3. সুস্পষ্ট জলবিভাজিকার সৃষ্টি- পার্শ্বক্ষয়ের জন্য জলবিভাজিকাগুলি সুস্পষ্ট হয় এবং এগুলি শৈলশিরার মতো অবস্থান করে।
4. উপত্যকার উচ্চতা হ্রাস- ক্রমাগত মস্তক ক্ষয়ের ফলে প্রধান নদীতে কোন জলপ্রপাত থাকেনা এবং নদী উপত্যকার উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে।
5. পর্যায়িত ঢালের সৃষ্টি- উচ্চতা কমতে কমতে একটা সময় প্রধান নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর পার্শ্বচিত্রে অর্থাৎ উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত একটি পর্যায়িত ঢাল (Graded profile or profile of equilibrium) সৃষ্টি হয় (নদীর ক্ষয়কার্য ও বহনকার্যের মধ্যে যখন একটি সমতা আসে তখন এই ধরনের ঢাল গড়ে ওঠে)। তবে উপনদীগুলিতে পর্যায়িত ঢাল নাও থাকতে পারে।
6. বিবিধ ভূমিরূপ সৃষ্টি- আড়াআড়ি পার্শ্বচিত্র অনুসারে নদী উপত্যকার আকৃতি সংকীর্ণ "V" থেকে ক্রমশ প্রশস্ত "V" তে পরিণত হয়। নদী উপত্যকায় প্লাবনভূমি এবং নদীবাঁকের (Meander) সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে নদীবক্ষে বালুচর (Bar) ও শোল (Shoal) তৈরি হয়। তবে যৌবন পর্যায়ে নদীর গতিপথে গঠিত জলপ্রপাত, হ্রদ ইত্যাদি এই পর্যায়ে আর দেখা যায় না।
7. নদীর সংখ্যা হ্রাস- পরিণত অবস্থার শেষের দিকে নদীর নিম্নক্ষয়ের তুলনায় পার্শ্বক্ষয় বাড়তে থাকে। এর ফলে নদীগুলি নিজ অববাহিকা অঞ্চলের বা পার্শ্ববর্তী অববাহিকা অঞ্চলের নদীগুলিকে গ্রাস করে। তাই নদীর সংখ্যাও কমতে থাকে।
8. নিম্নক্ষয়ের পরিবর্তে পার্শ্বক্ষয় বৃদ্ধি- পরিণত অবস্থায় নদীগুলির নিম্নক্ষয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, পরিবর্তে পার্শ্বক্ষয়ের কারণে নদী ও উপত্যকাগুলি ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে পড়ে।
C. বার্ধক্য অবস্থা (Old stage)- ক্ষয়চক্রের শেষ অবস্থা বা পর্যায়টিকে বার্ধক্য অবস্থা বলে। এ সময়ে নদীর নিম্নক্ষয় বন্ধ হয়ে যায়, শুধু পার্শ্বক্ষয় চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, ক্ষয়কার্যের ফলে যখন উত্থিত উচ্চ ভূমিভাগটি একটি প্রায় সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হয়, তখন ভূমিরূপ বার্ধক্য অবস্থা লাভ করে। এই অবস্থায় ভূমিরূপের যে বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায় সেগুলি হল-
ডেভিসের ক্ষয়চক্রের বার্ধক্য অবস্থা |
1. অগভীর ও প্রশস্ত উপত্যকা- ভূমিভাগের ঢাল কমে যায় বলে নদী উপত্যকা অগভীর এবং অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায় বা চওড়া হয়ে যায়।
2. নদীর সংখ্যা হ্রাস- পরিণত অবস্থার তুলনায় এ পর্যায়ে উপনদীর সংখ্যা কমে যায় (তবে যৌবন অবস্থার চেয়ে বেশি থাকে)।
3. প্রশস্ত ও অগভীর উপত্যাকা গঠন- পূর্ববর্তী নদী উপত্যকায় ক্রমাগত পলি সঞ্চয়ের ফলে নদী উপত্যকা ক্রমশ প্রশস্ত ও অগভীর হয়ে পড়ে।
4. চওড়া প্লাবনভূমি, স্বাভাবিক বাঁধ ও আঁকাবাঁকা গতিপথ- নদীর প্লাবনভূমি খুব চওড়া হয় এবং দুপাশের স্বাভাবিক বাঁধের মধ্য দিয়ে নদী ধীর গতিতে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়।
5. বিবিধ ভূমিরূপ সৃষ্টি- প্লাবনভূমিতে পরিতক্ত নদীবাঁক, জলাভূমি, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।
6. ঢাল হ্রাস- ঢাল কমে যায় বলে আবহবিকার সৃষ্ট শিলাচূর্ণ দ্বারা উপত্যকার ঢাল ঢাকা পড়ে যায়।
7. বিনুনি আকৃতির নদী- স্বল্প ঢালযুক্ত প্লাবনভূমি নদীর প্রবাহকে এতটাই কমিয়ে দেয় যে, অনেক সময় নদী অসংখ্য শাখায় ভাগ হয়ে বিনুনির আকারে প্রবাহিত হয়।
8. ক্ষয়প্রাপ্ত উচ্চভূমি- উচ্চভূমি বা জলবিভাজিকাসমূহ ক্ষয় হতে হতে এতটাই অস্পষ্ট হয়ে যায় যে সেগুলো খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়।
9. সমপ্রায়ভূমির সৃষ্টি- সুদীর্ঘ সময় ধরে ক্ষয় কার্যের ফলে সমগ্র ভূমিভাগটি ক্ষয়কার্যের শেষ সীমা (Base level of erosion) বা তার কাছাকাছি (সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি উচ্চতায়) পৌঁছে যায়। হ্ময়চক্রের শেষ পর্যায় বা বার্ধক্য অবস্থায় গঠিত এই অনুচ্চ প্রায় সমতলভূমিকে ডেভিস সমপ্রায় ভূমি (Pedi plain) নামে অভিহিত করেছেন।
10. মোনাডনক- সমপ্রায় ভূমির ওপর কঠিন শিলায় গঠিত বিচ্ছিন্ন ও স্বল্পোচ্চ টিলা পাহাড়কে বলে মোনাডনক (Monadnock)।
সুদীর্ঘ সময় ধরে বার্ধক্য অবস্থায় থাকার পরে ভূআলোড়নের ফলে পুনরায় ভূমি ভাগটি উত্থিত হলে পরবর্তী ক্ষয়চক্রের সূচনা হয়। এই অবস্থাকে ক্ষয়চক্রের পুনরুজ্জীবন (Rejuvenation of cycle of Erosion) বা দ্বিতীয় ক্ষয়চক্র (Second cycle of Erosion) বলা হয়।
1. জিনগত বৈচিত্র্য ( Genetic Diversity)
2. প্রজাতিগত বৈচিত্র্য (Species Diversity)
3. বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য (Ecosystem Diversity)
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত বা বাঁধা (Interruption of Fluvial Cycle)
ক্ষয়চক্র চলাকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান বা পতন হলে অথবা নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা হ্রাস অথবা বৃদ্ধি পেলে ক্ষয়চক্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে যায় অথবা ক্ষয়চক্র সম্পন্ন হতে পারে না। ক্ষয়চক্রের স্বাভাবিক গতি ব্যহত হয়। ক্ষয়চক্রের এইরূপ অবস্থাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত বা বিঘ্ন বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক পতন ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমা ঋণাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে ক্ষয়চক্র পুনরায় শুরু হয়। আবার, সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক উত্থান ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমা ধনাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই ক্ষয়চক্র শেষ হয়ে যায়।
ক্ষয়চক্রের বাধা সৃষ্টির কারণ:
প্রধানত তিনটি কারণে ক্ষয়চক্রের বাধা সৃষ্টি হয়ে থাকে-
1. ক্ষয়ের শেষ সীমার পরিবর্তন।
2. জলবায়ুর পরিবর্তন এবং
3. অগ্ন্যুদগম
1. ক্ষয়ের শেষ সীমার পরিবর্তন- ক্ষয়ের শেষ সীমার পরিবর্তন ঘটলে ক্ষয়চক্রে বাধার সৃষ্টি হয়। এটি দুইভাবে হয়ে থাকে। যেমন-
a. সমুদ্রপৃষ্ঠের ধনাত্মক পরিবর্তন: ভূমি ভাগের অবনমনের ফলে যদি মহাদেশীয় ভূভাগের সাপেক্ষে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যায় কিংবা হিমবাহ গলে গিয়ে সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে নদী হঠাৎই নিম্নক্ষয় সীমার কাছাকাছি চলে আসে। ফলে নদীর ক্ষয়কারী ক্ষমতা হ্রাস পায়। একে সমুদ্রপৃষ্ঠের ধনাত্মক পরিবর্তন (Positive change of sea level) বলে। এর ফলে কোনো অঞ্চলের ভূমিরূপ দ্রুত বা সরাসরি যৌবন থেকে বার্ধক্য বা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছায়। অর্থাৎ ক্ষয়চক্রের দ্রুত অগ্রগতি হয় এবং নির্ধারিত সময়ের সময়ের আগেই ক্ষয়চক্রের সমাপ্তি ঘটে।
b. সমুদ্রপৃষ্ঠের ঋণাত্মক পরিবর্তন- কোনো একটি অঞ্চলে ভূমিভাগ উঁচু হয়ে উঠলে একে সমুদ্রপৃষ্ঠের ঋণাত্মক পরিবর্তন(Negative change of sea level) বলে। এইভাবে কিংবা সমুদ্রের অনেকটা জল তুষার বা বরফ রূপে মহাদেশীয় ভূভাগে জমে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যেতে পারে। সমুদ্রতলের অবনমনের ফলে ক্ষয়ের শেষ সীমা থেকে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর সম্ভাব্য স্থিতিশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নদী পুনরায় আগের মতো ক্ষয় করার ক্ষমতা ফিরে পায়। একে নদীর পুনর্যৌবন লাভ বলা হয়। এটি তিন প্রকার- গতিময় পুনর্যৌবন লাভ, ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ এবং স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ।
2. জলবায়ুর পরিবর্তন-
a. বৃষ্টিপাতের
পরিমাণ বেড়ে গেলে নদীর জল বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ক্ষয় এবং বহনকাজ ও বৃদ্ধি পায়। আবার
বৃষ্টিপাত হ্রাস পেলে নদীর ক্ষয় ও বহন করার ক্ষমতা কমে গিয়ে অবক্ষেপণ বা সঞ্চয় কাজ
বৃদ্ধি পায়। উভয়ক্ষেত্রেই নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর ও আড়াআড়িভাবে গঠিত পার্শ্বচিত্রে(Longitudinal
and cross profile) মসৃণতা সৃষ্টির যে লক্ষ্যমাত্রা থাকে, তার পরিবর্তন ঘটে বলে ক্ষয়চক্র
বাধাপ্রাপ্ত হয়। আবার
b. জলবায়ু হঠাৎ শীতল হয়ে পড়লে নদীর পরিবর্তে হিমবাহের ক্ষয়কার্য প্রাধান্য পায়, অথবা জলবায়ু মরুপ্রকৃতির হয়ে গেলে নদীর বদলে বায়ুর ক্ষয়কার্য প্রাধান্যলাভ করে। ফলে দুটি ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
3. অগ্ন্যুদগম -
a. অগ্ন্যুৎপাতের
কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লাভা সঞ্চিত হলে, ক্ষয়চক্রটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ ক্ষয়চক্রের
ফলে গঠিত ভূমিরূপগুলি লাভা স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায়।
b. অনেক সময় নদীর গতিপথে আড়াআড়ি লাভা সঞ্চয়ের ফলে নদীর জল অবরুদ্ধ হয়ে একটি হ্রদ তৈরি হয়। পরে ক্রমাগত জল সঞ্চয়ের ফলে একসময় নদী ওই আড়াআড়ি লাভা সঞ্চয়ের পাশ দিয়ে অথবা বিপরীত দিকে বইতে থাকে।
ভূমির পুনর্যৌবন লাভ (Rejuvenation of land forms)
ভূমির পুনর্যৌবনলাভ (Rejuvenation of land forms) - ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন বাঁধার ফলে নদীর শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নদী তার পূর্ববর্তী মসৃণ উপত্যকায় আবার নতুন করে হ্ময়কাজ শুরু করে। একে ভূমির পুনর্যৌবন লাভ বলে।
নদীর পুনর্যৌবনলাভ (Rejuvenation of river)- সমুদ্রপৃষ্ঠের পতন ঘটল অথবা ভূ আলোড়নে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে নদীর ক্ষয় কাজ ক্ষমতা বেড়ে যায়। একে নদীর পুনর্যৌবন লাভ বলে।
পুনর্যৌবন লাভের উপায় বা শ্রেণীবিভাগ:
ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভ তিন প্রকার। যথা-
1. গতিময় পুনর্যৌবন লাভ (Dynamic Rejuvenation)- মহীভাবক বা গিরিজনি আলোড়ন এর ফলে হেলে (tilting) অথবা বেঁকে(warping) উত্থিত হয়ে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে, নদীর গতিপথের ঢাল বেড়ে যায়। এর ফলে নদীর গতিবেগ বেড়ে যায় এবং নতুন করে বেশি পরিমাণে নিম্নক্ষয় হতে থাকে। এইভাবে পুনরুত্থিত ভূমিভাগটির পুনর্যৌবন লাভ ঘটে। একে গতিময় পুনর্যৌবন বলে।
2. সমুদ্র তলের পরিবর্তনে পুনর্যৌবন লাভ (Eustatic Rejuvenation)- সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমনের ফলে যে পুনর্যৌবন লাভ ঘটে, তাকে ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ বলে। দুটি কারণে এটি হয় -
A. ভূআলোড়ন- ভূআলোড়নের জন্য সমুদ্রবক্ষ অবনমিত হলে সমুদ্রের জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও সমুদ্রপৃষ্ঠ নীচে নেমে যায়। এর ফলে তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে ভূমিভাগের উচ্চতা বেড়ে যায় বলে নদীর নিম্নক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিভাগটি পুনর্যৌবন লাভ করে। একে বলে ভূমিপর্যায়জনিত পুনর্যৌবন লাভ।
B. হিমবাহের প্রভাব- হিমযুগে সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হওয়ার পর তা ঘনীভূত হয়ে তুষার রূপে পার্বত্য অঞ্চলে সঞ্চিত হয়। ফলে সমুদ্রের জলের পরিমাণ কমে যায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন ঘটে ও ভূমিভাগ পুনর্যৌবন লাভ করে। একে হৈমিক বা ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ বলে।
3. স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ (Static Rejuvenation)- সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন বা ভূমিভাগের উত্থান ছাড়া অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে নদীর নিম্নক্ষয় বেড়ে গেলে ভূমিভাগটির যে পুনর্যৌবন ঘটে, তাকে স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ বলে। সাধারণত এটি তিনটি কারণে ঘটে।যথা-
A. নদীগ্রাস- মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে কোনো শক্তিশালী নদী দুর্বল নদীকে গ্রাস করলে ওই দুর্বল নদীর জল শক্তিশালী নদীতে এসে পড়ে। তখন শক্তিশালী নদীতে জলের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে নদী আগের চেয়ে শক্তিশালী হয় ও নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে ভূমিভাগ পুনরায় যৌবন অবস্থা ফিরে পায়।
B. নদীর বোঝা হ্রাস - নদীর বোঝা হ্রাস পেলে নদীর গতি বেড়ে যায় ও সর্বশক্তি দিয়ে নদী নিম্নহ্ময় শুরু করে। এর ফলে ভূমি ভাগ পুনরায় যৌবন অবস্থা ফিরে পায়।
C. জলবায়ুর পরিবর্তন- জলবায়ুর পরিবর্তন হলে (শুষ্ক জলবায়ু থেকে আদ্র জলবায়ুতে পরিবর্তন অর্থাৎ বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি) নদীতে জল বৃদ্ধি পায় ও নদীর নিম্নক্ষয় পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়। ফলে ভূমিভাগের পুনর্যৌবন লাভ ঘটে।
পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে গঠিত ভূমিরূপ গুলি কি কি?
1. নিক পয়েন্ট বা নিক বিন্দু (Knick Point)-
নদী ও ভূমিভাগের পুনর্যৌবন লাভের ফলে সৃষ্ট একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ হল নিক পয়েন্ট।
পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর পুরাতন মৃদু ঢাল ও নতুন খাড়া ঢালের সংযোগস্থলে সৃষ্ট খাঁজকে নিক পয়েন্ট বলে।
বৈশিষ্ট্য:
A. ইহা পুরনো ও নতুন নদী উপত্যকার সংযোগস্থল।
B. নিক বিন্দুতে নতুন ঢাল পুরানো ঢাল অপেক্ষা উঁচু হয়।
C এক্ষেত্রে নদী এক নতুন ঢালের সৃষ্টি করে।
D. নিক পয়েন্ট নদী মস্তকমুখী ক্ষয় বেশি করায় এটি ক্রমশ পিছু হটে এবং একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
E. নিক পয়েন্টে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। যেমন-
ক. ঝাড়খণ্ডের সুবর্ণরেখার হুণ্ড্রু জলপ্রপাত।
খ. মধ্যপ্রদেশে নর্মদার উপর ধোঁয়াধারার নিকপয়েন্টের জলপ্রপাত।
2. উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা (Valley in valley)-
ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভের ফলে নদীর উর্ধ্ব ও নিম্নপ্রবাহের মধ্যে ভূ-প্রকৃতিগত অসংগতি(Topographic unconformity) লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত নদী অববাহিকার উর্ধাংশে ভূমিরূপ পরিণত বা বার্ধক্য অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে নিম্নপ্রবাহে নদী পুরোনো উপত্যকাকে গভীরীকরণের মাধ্যমে সংকীর্ণ "V" আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি করে। উর্ধাংশে পুরোনো প্রশস্ত উপত্যকার ঢাল মৃদু থাকে ও নিম্নাংশে নবীন উপত্যকার ঢাল খাড়া হয়। এভাবে এই দুই উপত্যকার সংযোগস্থলে ঢালের বিচ্যুতি(Break of slope) জনিত একটি স্কন্ধ ভূমি(Shoulder land) গড়ে ওঠে। নিম্ন উপত্যকার আড়াআড়ি প্রস্থচ্ছেদ নিলে দেখা যায় যে, পুরাতন উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা অবস্থান করছে। এরূপ উপত্যকাকে "উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা" বা "দ্বিচক্র উপত্যকা" (Two cycle valley) বলে।
উপত্যাকার মধ্যে উপত্যকা |
3. নদীমঞ্চ (River Terrace)-
নদীর দু'পাশে অনেক সময় এক বা একাধিক ধাপ বা মঞ্চ দেখা যায়। পুনর্যৌবন প্রাপ্তির ফলে নদী নীচে উলম্বভাবে কেটে বসে যাওয়ার জন্য পূর্বেকার নদী উপত্যকার পরিত্যক্ত প্লাবন সমভূমি নদীর দু'পাশে কিছুটা ওপরে মঞ্চের আকারে অবস্থান করে। একে নদীমঞ্চ বলে। যদি নদীমঞ্চে যথেষ্ট পলল থাকে, তাহলে তাকে পলল নদীমঞ্চ বলে। অল্প পলল যুক্ত বা পলল শুন্য নদী মঞ্চকে প্রস্তরশয্যা নদীমঞ্চ(Bed rock terraces) বলে। পুনর্যৌবন লাভ এর ফলে গঠিত নদীমঞ্চের বৈশিষ্ট্য হলো উপত্যকার উভয়পার্শ্বে মঞ্চগুলি সমান উচ্চতায় জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। তাই এদের যুগল নদীমঞ্চ(Paired Terraces) বলে। এছাড়া অসমান উচ্চতায় যেসব নদীমঞ্চ গড়ে ওঠে, তাদের অযুগল নদী মঞ্চ বলে।
নদীমঞ্চ |
4. খোদিত নদীবাঁক (Incised Meander)-
পরিণত এবং বার্ধক্য অবস্থায় নদী সাধারণত বড় বড় বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হয়। পুনর্যৌবন প্রাপ্তি ঘটলো নদী বাঁকের মধ্যে নদী উলম্বভাবে কেটে (Vertical cutting) যেমন বসে যায়, তেমনি পার্শ্বক্ষয় (Lateral erosion) করে সরতে থাকে। একে কর্তিত বা খোদিত নদীবাঁক বলে। কর্তিত নদীবাঁক দুই প্রকারের হয়, যেমন- A. নিম্নহ্ময় প্রবল থাকলে নদী সরাসরি বাঁকের মধ্যে কেটে বসে যায় ও দুপাশে সমান খাড়া প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ থকে। এদের সমখাড়া পরিখাবেষ্টিত (Entrenched or Intrenched) নদীবাঁক বলে।
B. কোনো কোনো ক্ষেত্রে নদীর নিম্নহ্ময় অপেক্ষা পার্শ্বহ্ময় বেশি হলে নদী একপাশে সরতে থাকে এবং সেক্ষেত্রে নদীবাঁকের উভয় পার্শ্বের ভূমির ঢাল একই প্রকার থাকে না, একপাশ বেশি খাড়া ও অন্যপাশ অপেক্ষাকৃত মৃদু ঢালযুক্ত হয়। একে অসমখাড়া পরিখাবেষ্টিত (Ingrown) নদীবাঁক বলে।
খোদিত নদীবাঁক |
5. উত্থিত সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রমঞ্চ (Raised Beaches and Marine Terraces)-
যদি সমুদ্র বহুদিন ধরে উপকূলভাগে ক্ষয়কার্য করে, তবে ওই অঞ্চলে সাধারণত অপক্ষেপ যুক্ত অথবা অধক্ষেপহীন সৈকতের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় উপকূলভাগ উত্থিত হলে কিংবা সমুদ্রতলের পতন হলে পূর্বেকার সৈকত বর্তমান সমুদ্রতলের ঊর্ধ্বে মঞ্চ বা বেঞ্চের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মঞ্চের উচ্চতা 50 মিটারের কম হলে তাকে উত্থিত সমুদ্রসৈকত( Raised Beaches) ও 50 মিটারের বেশি হলে তাকে সমুদ্রমঞ্চ(Marine Terrace) বলে। গ্রেট ব্রিটেনের দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে উত্থিত সমুদ্রসৈকত গড়ে উঠেছে।
ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নদীর দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির পরিচয় দাও।
নদীর ক্ষয়কার্যের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন
প্রকার ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়।
যেমন-
1. যৌবন পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ
গিরিখাত ও ক্যানিয়ন: স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের যৌবন পর্যায়ে নদীর ঢাল বেশি
থাকে। তাই নদী দুরন্ত গতিতে
নিম্নক্ষয়
করে এগিয়ে চলে। ফলে নদী-উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়। উপত্যকাটি ‘I' আকৃতির রূপ নেয়।
আবহবিকার, ধস ও জলপ্রবাহের ফলে এই ‘I’ আকৃতির উপত্যকার দুই পাড় বিস্তৃত হয়ে ‘v’ আকৃতির
উপত্যকা গঠন করে। নদী উপত্যকা ভীষণ গভীর ও সংকীর্ণ হয়ে গিরিখাত সৃষ্টি করে। এই পর্যায়ে
নদীর ঢাল অত্যন্ত বেশি থাকে বলে এর পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় বেশি হয়। ক্রমাগত
নিম্নক্ষয়ের ফলে এই অঞ্চলে খাড়াপাড়যুক্ত গভীর গিরিখাত সৃষ্টি হয়। শুষ্ক অঞলের মধ্য
দিয়ে প্রবাহিত নদী অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাত সৃষ্টি করে, একে ক্যানিয়ন বলে।
শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবে পার্শ্বক্ষয় বিশেষ হয় না, কিন্তু নিম্নক্ষয় হয়
সর্বাধিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের শুষ্ক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কলােরাডাে
নদী পৃথিবীর গভীরতম ক্যানিয়ন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে।
শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ শৈলশিরা: পার্বত্য অঞ্চলে শৈলশিরাগুলি উপত্যকার দিকে নেমে এলে
নদী শৈলশিরার বাধা এড়িয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। তাই মনে হয় শৈলশিরাগুলি শৃঙ্খলিত
বা আবদ্ধ অবস্থায় আছে। একে আবদ্ধ শৈলশিরা বলে। দার্জিলিং হিমালয়ে বহু শৃঙ্খলিত শৈলশিরা
দেখা যায়।
শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ শৈলশিরা |
জলপ্রপাত: নদীর গতিপথে জলতলের আকস্মিক উল্লম্ব বা প্রায় উল্লম্ব পতনকে জলপ্রপাত বলে। এই পর্যায়ে নদী-ঢালের পরিবর্তনের ফলে প্রবল জলরাশি খাড়া ঢালের নীচে নেমে এলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আমেরিকার সাল্টো অ্যাঞ্জেল (980 মি) পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত। প্রবল জলধারা বা নদী পরপর কয়েকটি জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে শ্রেণিবদ্ধ জলপ্রপাত বা ক্যাটার্যাক্ট বলে। একাধিক ছোটো ছোটো জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নদী প্রবাহিত হলে যে সারিবদ্ধ ক্ষুদ্রাকার জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে ক্যাসকেড বা নিপর বলে। নদীর স্বাভাবিক গতির চেয়ে সামান্য তীব্রগতিতে সিঁড়ির মতো ছটো ছোটো ধাপে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে খরস্রোত বলে।
জলপ্রপাত |
মন্থকূপ বা পটহোল : নদীর গতিপথে কোমল শিলা অবস্থান করলে নদীবাহিত কঠিন শিলাখণ্ডের আঘাতে ঐ কোমল শিলায় গর্তের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ডসহ জল ওই গর্তে আবর্তিত হয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। নদীগর্ভে এইরূপ গর্তবিশিষ্ট ভূমিরূপকে মন্থকূপ বা পটহােল বলে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লাইড নদী উপত্যকার তলদেশে অনেক মন্থকূপ দেখা যায়।
পরিণত পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ:
পরিণত অবস্থায় জলবিভাজিকার শীর্ষদেশ সুতীঘ্ন হয়।
এই পর্যায়ে নদীর ঢাল পর্যায়িত অবস্থায় পৌঁছোয় বলে পূর্বের জলপ্রপাত, হ্রদ, জলাভূমি
প্রভৃতি লুপ্ত হয়।
পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু: এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ও গতিবেগ কমে যায় বলে নদীবাহিত
শিলাখণ্ড, নুড়ি, বালি, কর্দম প্রভৃতি পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে পলল ব্যজনী ও পলল শঙ্কু
গঠন করে। পলল শঙ্কু ও পলল ব্যজনী অর্ধবৃত্তকার হয়। এদের নীচের অংশ বেশ চওড়া কিন্তু
ওপরের অংশ ক্রমশ সরু হয়ে শঙ্কুর আকার ধারণ করে। পলল ব্যজনী সাধারণত অতি সুক্ষ পদার্থ
দ্বারা গঠিত হয়। তাই এর বেধ কম, কিন্তু পলল শঙ্কু বড়ো বড়ো শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর
ও বালুকণা দ্বারা গঠিত হয়।
প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ: এই পর্যায়ে প্লাবনভূমি উপত্যকার সিংহভাগ জুড়ে অবস্থান করে। নদীর ঢাল কমে যাওয়ায় নদীর বহন ক্ষমতা কমে যায়। তাই জলের সঙ্গে বাহিত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হয়ে প্লাবনভূমি সৃষ্টি করে। আবার, নদীর দুকূলে বাহিত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হয়ে বাঁধের আকৃতির যে ভূমিরূপ গঠন করে তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে।
নদীচর বা নদীদ্বীপ; নদীর ঢাল কমে যাওয়ায় নদীর বহন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে, নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীগর্ভে ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে চর বা চড়ার সৃষ্টি হয়। নদীর চড়ায় বারংবার পলি সঞ্চয়ের ফলে চড়াগুলি উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিণত হয়। নদীগর্ভে অসংখ্য চর বা দ্বীপ থাকলে নদী এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। অসমের ব্ৰহ্মপুত্র নদীর গতিপথে গড়ে ওঠা মাজুলি দ্বীপটি বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বীপ।
নদীচর |
বার্ধক্য পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপ
প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ: এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ভীষণভাবে কমে যায়। ফলে নদীর বহন ক্ষমতাও কমে যায়। তাই নদীবাহিত পদার্থসমূহ দীর্ঘদিন ধরে নদীখাতে সঞ্চিত হয়ে নদীখাতকে ভরাট করে তােলে। নদীর দুকুল বরাবর বালি সঞ্চিত হয়ে বাঁধের আকারে যে দীর্ঘ ভূমিরূপ গড়ে ওঠে তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে। বন্যার সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে অগভীর নদীখাত দিয়ে ওই জল প্রবাহিত হতে পারে না। অতিরিক্ত জল দুকূল পার্শ্ববর্তী উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। জলের সঙ্গে বাহিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে প্লাবনভূমি গড়ে ওঠে।
নদীচর ও নদীদ্বীপ: নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীখাতে ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে
চর বা চড়ার সৃষ্টি হয়। চড়াগুলিতে বারবার পলি সঞ্চিত হয়ে উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিণত
হয়।
নদীবাঁক: নদী চলার পথে বাধা পেলে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। জলস্রোত
নদীবাঁকের যে অংশে আঘাত করে সেখানে ক্ষয় হয় এবং বিপরীত অংশে পলি সঞ্চিত হয়ে বিন্দুবার সৃষ্টি করে। ধারাবাহিকভাবে নদীতে ক্ষয় সঞ্চয়ের ফলে নদীতে অসংখ্য নদীবাঁক
সৃষ্টি হয়।
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ: নদী খুৰ এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। পরপর দুটি নদীবাঁকের মধ্যবর্তী অংশ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তীকালে নদীৰাঁক সংযুক্ত হলে নদী বাঁকা পথে ছেড়ে সোজাপথে চলে। ফলে পরিত্যক্ত নদীবাঁকটি অশ্বের ক্ষুরের আকার ধারণ করে। একে অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ বলে।
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ |
পেনিপ্লেন ও মোনাডনক: ক্ষয়চক্রের অন্তিম পর্যায়ে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে
বিস্তীর্ণ অঞল ক্ষয়ের শেষ সীমায় বা তার কাছাকাছি অবস্থান করলে বৈচিত্র্যহীন সমপ্রায়ভূমি সৃষ্টি হয়। একে পেনিপ্লেন বলে। এই সমপ্রায় ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ক্ষয়প্রতিরােধী
শিলায় গঠিত স্বল্প উঁচু টিলা বা পাহাড় দেখা যায়। এই পাহাড় বা টিলাকে মোনাডনক বলে।
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের পূর্বশর্ত (Pre conditions of normal cycle of Erosion)
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের পূর্বশর্ত (Pre conditions of normal cycle of Erosion) কি কি?
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের কাজ ঠিকমতো হওয়ার জন্য ডেভিস কতকগুলি আদর্শ অবস্থার কথা বলেছেন।এগুলি হল-
1. সমুদ্র থেকে উত্থান- ভূমিভাগটি একটি ভূতাত্ত্বিক একক (Geographical Unit) হিসেবে সমুদ্র থেকে উত্থিত হবে।
2. উলম্ব এবং দ্রুত উত্থান - প্রধানত ভূআলোড়নের জন্য ভূমিভাগটির উলম্ব উত্থান ঘটবে এবং প্রারম্ভিক উত্থানের হার যথেষ্ট দ্রুত হবে। এছাড়া উত্থানপর্ব চলার সময় ভূমিভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না।
3. ভূমি ভাগের বিভিন্ন গঠন- উত্থিত ভূমিভাগটির গঠন ভাঁজযুক্ত, চ্যুতিযুক্ত ইত্যাদি হতে পারে।
4. শিলার গঠনগত সমতা- ভূমিভাগের সর্বত্রই শিলার গঠনগত সমতা থাকবে এবং পর্যায়ক্রমে কঠিন ও কোমল শিলা থাকবে।
5. ভূমি ভাগের সমুদ্রমুখী ঢাল- ভূমিভাগের প্রাথমিক ঢাল হবে সমুদ্রমুখী।
6. সহজাত বন্ধুরতা- ভূমিভাগটির উত্থানের সময় বিকৃতি ও তারতম্যজনিত সহজাত বন্ধুরতা থাকবে।
7. আদ্র জলবায়ু- অঞ্চলটির জলবায়ু হবে আদ্র, যাতে নদীগোষ্ঠী সৃষ্টি হয় এবং নদীর মাধ্যমে হ্ময় প্রাধান্য লাভ করে।
8. অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া- নদীর ক্ষয় ছাড়াও আবহবিকার, পুঞ্জিতক্ষয় (Mass wasting) প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলি ভূমিরূপের বিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
9. পর্যায় অনুসরণ- ভূমিরূপের বিবর্তন কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায় (যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্য) অনুসারে ঘটতে থাকবে।
10. সমপ্রায়ভূমি গঠন- ক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে সমগ্র ভূমিভাগটি একটি প্রায় সমতল সমপ্রায়ভূমিতে (peneplain) পরিণত হবে এবং তার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকবে।
11. ক্ষয়ের শেষ সীমা- উত্থিত ভূমির ক্ষয়কার্য সমুদ্রপৃষ্ঠ পর্যন্ত চলতেই থাকবে এবং এই সমুদ্রপৃষ্ঠ বা সমুদ্রসমতলই হবে ক্ষয়ের শেষ সীমা (Base level of Erosion)।
12. ভূমিভাগের স্থিতিশীলতা- ক্ষয় চলাকালীন ভূমিভাগের উত্থান ঘটবে না। যদি ঘটে তাহলে একটি নতুন ক্ষয়চক্রের সূচনা হবে।
*এল. সি. কিং এর মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্র তত্ত্ব বা পেডিপ্লেন গঠন তত্ত্ব (L.C King's arid cycle theory or theory of pediplanation):
দক্ষিণ আফ্রিকার মরু, মরুপ্রায় ও সাভানা অঞ্চলের ভূমিরূপ সম্পর্কে দীর্ঘ গবেষণার পর 1948 সালে এল.সি.কিং মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্র সম্পর্কে একটি তথ্য প্রকাশ করেন, যার নাম Theory of pediplanation বা পেডিপ্লেন গঠন তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো পর্যায়ক্রমে যৌবন, পরিণত বা প্রৌঢ় এবং বার্ধক্য অবস্থার মধ্য দিয়ে মরু অঞ্চলের ভূমিরূপ পেডিপ্লেন বা পাদদেশীয় সমভূমিতে পরিণত হয়। কিং এর মতে আগেকার কোন পেডিপ্লেনের উত্থানের মাধ্যমে মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের সূচনা হয়, যাকে বলা হয় যৌবন পর্যায়।
1. যৌবন পর্যায় (Youth Stage)- যৌবন অবস্থায় মরু অঞ্চলের উচ্চভূমি বা পর্বতগুলির প্রান্তদেশ যথেষ্ট খাড়া ঢালযুক্ত হয়। একে কিং বলেছেন ভৃগু। এরপর ক্ষয়কাজের ফলে ওখানে প্রথমে পেডিমেন্ট (pediment) এবং পরে ইনসেলবার্জ (lnselberg) গঠিত হয়।
a. আবহবিকার ও জলধারার কাজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ধীরে ধীরে ওই ভৃগু বা খাড়া ঢালের সমান্তরাল পশ্চাদপসরণ ঘটে এবং সেখানে পেডিমেন্ট গঠিত হয়।
b. এইভাবে পেডিমেন্টের ক্রমশ প্রসার ঘটলে জলবিভাজিকাসমূহ বা দুই উপত্যকার মধ্যবর্তী উচ্চভূমিগুলি সংকীর্ণ হতে থাকে এবং শেষে ওগুলি খাড়া ঢালযুক্ত অবশিষ্ট পাহাড় বা ইনসেলবার্জে পরিণত হয়। ক্ষয় কার্যের তীব্রতার পার্থক্যের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন আকৃতির ইনসেলবার্জ গড়ে ওঠে।
c. ক্ষয়কার্য কম হলে যে বৃহদাকৃতির ইনসেলবার্জ সৃষ্টি হয় তাকে বলে মেসা (Mesa)। আবার, ক্ষয়কার্য বেশি হলে যেসব ক্ষুদ্রাকৃতি ইনসেলবার্জ গঠিত হয় সেগুলিকে বলে বুটেস বা বিউটস (Buttes)। এর মধ্যে গোলাকার ইনসেলবার্জকে বনহার্ট (Bornhardt)বলে।
2. পরিণত পর্যায় (Mature Stage)- এরপর পরিণত অবস্থায় পেডিমেন্টের আরো প্রসার ঘটে। তখন অনেক ইনসেলবার্জই অবলুপ্ত হয় এবং এর ফলে ইনসেলবার্জ তথা জলবিভাজিকার উভয় দিকের পেডিমেন্ট সংযুক্ত হয়ে একটি বিস্তৃত সমভূমি বা পেডিপ্লেন গড়ে ওঠে।
3. বার্ধক্য পর্যায় (Old Stage)- ক্ষয়চক্রের একেবারে শেষ পর্যায়ে অধিকাংশ ইনসেলবার্জই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং এর ফলে তখন ভূমির বন্ধুরতা তথা ঢালও বিশেষ থাকে না। সেই সময় অনেকগুলি পেডিপ্লেন পরস্পর সংযুক্ত হয়ে সুবিস্তৃত পেডিপ্লেন গঠিত হয়।